বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা লেনদেন ভারসাম্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এ সময়ে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার কোটি (প্রতি ডলার ১০০ টাকা ধরে) টাকার বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়েও এ হিসাবে ঘাটতি ছিল, যার পরিমাণ ৩৮৩ কোটি ডলার।নানা উদ্যোগে আমদানি ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমলেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেনে ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। মূলত দুটি কারণে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। প্রথমত, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে রপ্তানি আয় মোটামুটি ভালো থাকলেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে পাঠানো অর্থের প্রবাহে ধীরগতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড় কমে গেছে। দুয়ে মিলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ কয়েক মাস ধরে লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি আনার তৎপরতা বাড়িয়েছে।কোনো দেশের চলতি হিসাব মূলত বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য এবং মানুষের আয়কেন্দ্রিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব। বাংলাদেশ জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার (অন্তত ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা) মূল্যমানের পণ্য আমদানি করেছে। আর সেবা আমদানি করেছে ৪৩৩ কোটি ডলারের। তাহলে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার। এখন দেখা যাক, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আয় কত করেছে। এ সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার এবং সেবা রপ্তানি থেকে এসেছে ১৩৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৭২০ কোটি ডলার। এর বাইরে সামান্য কিছু আয় ও ব্যয় রয়েছে। ফলে চলতি হিসাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঋণাত্মক।
দেশে প্রায় এক বছর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার প্রবণতার মধ্যে রয়েছে, যার মূল কারণ হলো, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দম কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্তত ৬ মাস ধরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতি ডলার কিনতে এখন আমদানিকারকদের ১০৫ থেকে ১১০ টাকা গুনতে হচ্ছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমে গেছে, যা অর্থনীতিতে এখন বড় আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের সামনে উপায় ছিল বা আছে, আমদানি যথাসম্ভব কমানো এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এ পরিসংখ্যান বলছে, আমদানি ব্যয় ওই চার মাসে কমেনি। তবে বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৩৬ শতাংশ। ফলে আমদানির ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমানো গেছে। অন্যদিকে ওই চার মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরে বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ। যদি রপ্তানিতে আরেকটি বেশি প্রবৃদ্ধি থাকত এবং আমদানি গত অর্থবছরের মতোই থাকত, তাহলে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে যেত। আবার গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে যায় ১৫ শতাংশ। এই চার মাসে তা ২ শতাংশের মতো বেড়েছে।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য :করোনার কারণে গত অর্থবছরে বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রবাহ বেশ বেড়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থবছরের এ পর্যন্ত বৈিেদশক ঋণ প্রবাহে গতি নেই। তাদের অর্থছাড় কমে গেছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এসেছে ১৮৮ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। অবশ্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ৩৭ শতাংশ বেড়ে ১৫৫ কোটি ডলার হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও ঋণ কমে যাওয়ায় আলোচ্য চার মাসে আর্থিক হিসাবে প্রায় ৪ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হিসাবে ২৭৯ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। সুতারং চলতি হিসাবে এবং আর্থিক হিসাবে ঘাটতি মিলিয়ে ৪৮৭ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এখানে ঘাটতি ছিল ১৩৪ কোটি ডলার।