বাজেট সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ঢাকা সফররত মিশন বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ও আইএমএফ কর্মকর্তারা ঋণের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। মিশনটি বাংলাদেশের ঋণের বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করবে এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদে ঋণ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
গত ১৫ দিনে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি তাদের নানা সংস্কারের শর্ত নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের সঙ্গে ৩০টি বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে সরকার তাদের শর্ত মেনে নেওয়ায় ঋণ দিতে সম্মত হয় সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের সংস্কারের শর্তগুলো এমনিতেই বাস্তবায়ন দরকার ছিল। এসব সংস্কার হলে দেশ উপকৃত হবে।অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় হবে। এ ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সুরক্ষায় সহায়তা করবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার এবং আইএমএফ।
বিবৃতিতে বলা হয়, আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩২০ কোটি ডলার এবং জলবায়ুবিষয়ক রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) থেকে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে তাঁরা একমত হয়েছেন। এ ঋণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। ৪২ মাস ধরে এ ঋণ দেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আইএমএফের ঋণের রেয়াতকাল থাকবে ৫ বছর এবং এর পর ১০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার হতে পারে গড়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
আইএমএফের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারের এসব পদক্ষেপ বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে; অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা কমাবে এবং অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু ব্যয় মেটানোর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
ঢাকা সফর শেষে আইএমএফ মিশনের বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এই প্রক্রিয়ার এ পর্যন্ত শেষ ধাপে দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকা সফরে রয়েছে আইএমএফ মিশন। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসেন এ মিশনের সদস্যরা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের সঙ্গে একাধিকবার মোট ৩০টি বৈঠক করেন তাঁরা। ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থার এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের কর্মকর্তা রাহুল আনন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে মিশনপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে নীতিসহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা ঋণ দিতে সম্মত। আইএমএফ এমন এক সময় ঋণ দিচ্ছে যখন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আইএমএফ উদ্বিগ্ন কিনা- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে আইএমএফ মিশনপ্রধান বলেন, এ দেশের রাজনীতি নিয়ে আইএমএফের কোনো উদ্বেগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব রয়েছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রিজার্ভ কতটুকু উদ্বেগের- এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি রাহুল আনন্দ। তিনি বলেন, সাড়ে তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ বাংলাদেশের হাতে রয়েছে। কতটুকু উদ্বেগের, তা নির্ভর করছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। বৈদেশিক উৎস থেকে কতটুকু সহায়তা পাওয়া যাবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ এখনও স্বস্তিদায়ক সীমার মধ্যে রয়েছে। তবে তাঁরা মনে করেন, রিজার্ভ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশ্ব অর্থনীতির সংকট কবে নাগাদ কাটবে, কেউ জানে না। রিজার্ভ বাড়াতে আমদানি-বিকল্প পণ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাড়ানো ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া উচিত।
কোন কারণে রিজার্ভ কমলো- এমন প্রশ্নের জবাবে আইএমএফের মিশনপ্রধান বলেন, করোনাকালে ৪৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছিল রিজার্ভ। ওই সময় যাতায়াত সংকটে হুন্ডির সুযোগ কম থাকায় রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। রপ্তানি খাতও দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আমদানি কম ছিল। এ কারণে রিজার্ভ বেশি ছিল। গত অর্থবছর রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ হারে, যা যথেষ্ট ছিল না। এসব মিলিয়ে রিজার্ভ কমেছে। তবে রিজার্ভ নিরাপদ রাখা দরকার। বাংলাদেশের রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, তা প্রকৃত নয়। রিজার্ভের যে অংশ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া হয়েছে, তা বাদ দিয়ে প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ বিষয়ে তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন।
মূল্যস্ম্ফীতি-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের মন্তব্যে রাহুল আনন্দ বলেন, অক্টোবরে মূল্যস্ম্ফীতি কিছুটা কমে এলেও এ হার এখনও অনেক বেশি। সারাবিশ্বেই পণ্যমূল্য বেড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব পণ্যই আমদানিনির্ভর। এ কারণে দেশেও মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণেও মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বাড়ছে।
ভর্তুকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে। নাজুক অবস্থায় থাকা দরিদ্র মানুষের সামাজিক সুরক্ষা সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ঢালাওভাবে সবার জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে মিশনপ্রধান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি এ মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশও চাপে আছে। এসব বিবেচনায় রাজস্ব কাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, মুদ্রানীতি ও বাণিজ্যনীতি আধুনিকায়নের কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট রপ্তানি পণ্য এবং বাজারনির্ভরতা থেকে বহুমুখীকরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জলবায়ুর অভিঘাত প্রশমনে ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ আন্তরিক।
বিশেষজ্ঞ মত :আইএমএফের ঋণ দেশের অর্থনৈতিক সংকটে কতটুকু সহায়ক হবে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের পূর্বের রেকর্ড ভালো। এখন আইএমএফ ঋণ দিতে সম্মত হওয়ায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্যান্য সংস্থার ঋণ পাওয়া সহজ হবে। অন্য সংস্থা থেকে ঋণ পেতে এখন আর তেমন যাচাইয়ের দরকার হবে না।
তিনি বলেন, আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলেছে, তা এমনিতেই দরকার ছিল। বিশেষ করে আর্থিক খাতের সংস্কার ও অর্থ পাচার বন্ধ করতে পারলে দেশ উপকৃত হবে। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণ ছাড় শুরুর পর প্রতিটি ধাপে সংস্কারের বিষয়টি যাচাই হবে। ফলে শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দিলেই হবে না; আসলেই ভালো করতে হবে। দেশের জন্য এটা ইতিবাচক।
ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির আশা :আইএমএফ মিশন জানিয়েছে, তাদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা ও তাদের পর্ষদে চূড়ান্ত অনুমোদন হবে। ঋণ মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে। আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ আইএমএফ প্রথম কিস্তি প্রায় ৪৬ কোটি ডলার ছাড় করবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে। বাকি ঋণ ছয় মাস পরপর ছয়টি সমান কিস্তিতে (প্রতি কিস্তি প্রায় ৬৮ কোটি ডলার) ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে। অর্থ মন্ত্রণলায় বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সুদের হার আইএমএফের নিজস্ব মুদ্রা স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস-এসডিআরের ভাসমান বা উন্মুক্ত হারের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। তবে সব মিলিয়ে সুদের গড় হার হতে পারে ২ দশমিক ২ শতাংশ। মোট ঋণের ওপর গড় সুদের হার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি-ইসিএফের প্রায় ১০৭ কোটি ডলার ঋণ হবে সুদমুক্ত। এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি-ইএফএফের সুদহার হাবে ভাসমান (ফ্লোটিং) এসডিআরের সঙ্গে ১ শতাংশ। অন্যদিকে রেজিলিয়েন্স ট্রাস্ট ফ্যাসিলিটি-আরটিএফের ১০০ কোটি ডলার ঋণের সুদহার হবে এসডিআর রেটের সঙ্গে বাড়তি শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
যেসব সংস্কার করবে সরকার :আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিতে সরকার কিছু বিষয়ে সংস্কার করতে চায়। সফররত আইএমএফ মিশনের বিবৃতিতে এর উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। তবে বিবৃতিতে আইএমএফের ‘শর্ত’ হিসেবে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বিষয়ে সংস্কারে সম্মত হয়েছে সরকার। এগুলো হলো- বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জায়গা তৈরি করা, মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা।
এতে বলা হয়েছে, বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জন্য উচ্চ রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করা হবে, যা প্রবৃদ্ধিসহায়ক খরচ বাড়াতে সহায়ক হবে। অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের ওপর প্রভাব মোকাবিলায় উচ্চ সামাজিক ব্যয় করা হবে এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অধিকতর লক্ষ্যনির্দিষ্ট হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি মূল্যস্ম্ফীতির দিকেই দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। মুদ্রার বিনিময় হার অধিকতর উন্মুক্ত করলে বহিস্থ অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে মনে করছে আইএমএফ।
এ ছাড়া আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমাতে তদারকি, সুশাসন এবং রেগুলেটরি কাঠামো জোরদার করা হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশের উন্নতি করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং বাড়তি অর্থায়ন জোগাড় করা হবে।