প্রশ্ন উঠেছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এই অনুচ্ছেদের জন্য দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিতে পারছেন না। এটাকেও গণতন্ত্রের পরিপন্থি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োজন রয়েছে। তবে মৌলিক অধিকার ইস্যুতে এ অনুচ্ছেদে কিছু শিথিলতা আনা প্রয়োজন।বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। স্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে সংবাদক্ষেত্রেরও। এই ত্রয়ী স্বাধীনতা গণতন্ত্রেরও মৌল ভিত্তি। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রণীত কয়েকটি আইনের মাধ্যমে সংকুচিত করা হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এতে অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে।সংসদেও বিরোধী দলের সদস্যরা এ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে রিট করা হলে তাতে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চের রায়ে রিটটি খারিজ করা হয়।
২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে আওয়ামী লীগ সরকার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করে এই আইন করা হয়। কিন্তু এই আইনের চারটি ধারা (২৫, ২৮, ২৯, ৩১) নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ ও শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের সম্পাদকরাও নজিরবিহীনভাবে এ আইনের প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলেন।
প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার পাশাপাশি ভিন্নমত দমনেও এ আইন ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সরকারও এ আইনের অপপ্রয়োগের কথা স্বীকার করেছে।
গত চার বছরে এই আইনের আওতায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ মামলা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উল্লিখিত চারটি ধারা চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। পরে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। বিষয়টি এখনও হাইকোর্টে অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এই আইনে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা ৫১৪টি মামলার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা যায়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৯৩টি। এসব মামলায় মোট আসামি ৯৭৪ জন। অর্থাৎ ১৯ শতাংশ আসামিই হচ্ছেন সাংবাদিক।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে মাশুল গুনতে হয় সাংবাদিকদের। এই আইনের কারণে শুধু সংবাদপত্র নয়, বাংলাদেশে নাগরিকের জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চাও বাধার মুখে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
জানতে চাইলে বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল সমকালকে বলেন, ‘সংবিধানে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে এটাও বলা আছে, রাষ্ট্র যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মাধ্যমে ৩৯ অনুচ্ছেদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই সুযোগটা নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আইনপ্রণেতারা সংবিধানের মূল চেতনা ধারণ করলে এটা হওয়ার কথা নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যেসব আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো সংবিধানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে।’
তিনি আরও বলেন, সরকার তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করেছে সংবিধানের চেতনা ধারণ করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুরোনো আইন বা নতুন আইনের মাধ্যমে এমন কিছু বিধি আরোপ করা হচ্ছে, যাতে তার অপব্যবহার হয়। এতে গণমাধ্যম ও জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। সাংবিধানিক অধিকারকে আইনের মাধ্যমে নানা শর্তের আড়ালে বাধাপ্রাপ্ত করা হলে সেটা কালো আইন, তা জনগণের জন্য নয়।
১৯৭২ সালে মূল সংবিধানেই ৭০ অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। অথচ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা সংসদেও মতপ্রকাশে স্বাধীন নন। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। এই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিভক্ত আদেশ দেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ রিটটি খারিজ করেন।
উচ্চ আদালতে বহুল আলোচিত বেশ কয়েকটি সাংবিধানিক বিষয়ে রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, ‘১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন; সেটা হলো, পাকিস্তান আমলে সংসদ সদস্যদের কেনাবেচার মাধ্যমে সরকার পতনের ব্যবস্থা করা হতো। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ, অর্থাৎ সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য এই অনুচ্ছেদ আনা হয়। এর অর্থ এই নয়, কোনো বিষয়ে সংসদে সংসদ সদস্যরা তাঁদের মতামত দিতে পারবেন না। আমি সেভাবে চিন্তা করি না।’
অবশ্য ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দের মতে, সরকারের প্রতি অনাস্থা, বাজেট এবং রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ কিছুটা শিথিল করে সংসদ সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।
ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারও সংবিধানস্বীকৃত। তবে এটিও শর্তসাপেক্ষ। ‘গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ’ শিরোনামে সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের- ক. প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং খ. চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’
তবে সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বলছে, নানাভাবে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনসাধারণের মনোজগতেও। গত অক্টোবরে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনরের এক জরিপেও এ উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী এক হাজার বাংলাদেশি উত্তরদাতার মধ্যে ৯৭ শতাংশই বলেছেন, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ রয়েছে।
গত কয়েক বছরে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রস্তাবিত আইন, নীতিমালা ও বিধিমালা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এর মধ্যে গণমাধ্যমকর্মী আইন, প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) অ্যাক্ট, তথ্য অধিকার পরিকাঠামো, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রবিধানমালা এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটি (ওভার দ্য টপ) নীতিমালা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়েও বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ রয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ আইনটির কিছু ধারাকে মানবাধিকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে এগুলোর অপব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলছে, আইনটি কার্যকর হলে নাগরিকের তথ্য-উপাত্তে সরকারি নজরদারি বাড়বে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী সমকালকে বলেন, ‘আমাদের সংবিধানটি আধুনিক। এ সংবিধানে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন আইনের আওতায় নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধন করা হয়নি। ফলে মুক্তচিন্তার প্রকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংবিধানের অনুচ্ছেদে রাখলেই হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে হবে।’
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কখনও সংবাদমাধ্যম বা জনগণের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার জন্য করা হয়নি। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হয়েছে। আইনটি প্রণয়নের পর প্রথম দিকে প্রয়োগের সময় কিছু অপব্যবহার হয়েছিল, সেটা আমরা সংশোধন করে দিয়েছি।’
৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘এটির প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সংসদ সদস্যরা দল থেকে মনোনীত হয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হন। তাই কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে চান, তাহলে তাঁর অবশ্যই দল থেকে পদত্যাগ করে ফের পুনর্নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসা উচিত। এটা এ জন্য যে, তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন একটি দলের মনোনয়নে, দলের ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য। এখন কেউ যদি দলের বাইরে যেতে চান, তাহলে গণতন্ত্র দাবি করে, তিনি জনগণের কাছে আবার ফিরে গিয়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসবেন।’
আইনমন্ত্রীর মতে, ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা নয়। আর যেসব দেশে সামরিক শাসন ছিল, সেখান থেকে এ ধরনের অনুচ্ছেদ হুট করে তুলে ফেলাও যৌক্তিক হবে না।