বর্তমানে দেশটির ৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় ভুগছেন। তাঁরা চশমা ব্যবহার করেন। এ সমস্যাকে চিকিৎসকরা বিজ্ঞানের ভাষায় বলেন ‘মায়োপিয়া’। সিঙ্গাপুরকে এখন বিশ্বে ‘মায়োপিয়ার রাজধানী’ বলা হয়। দেশটির জাতীয় চক্ষু সেন্টারের (এসএনইসি) জ্যেষ্ঠ পরামর্শক সহকারী অধ্যাপক অড্রি চিয়া বলেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে এখন অনেকটাই অভ্যস্ত। সিঙ্গাপুরে এখন প্রায় সবাই ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত।
গত শতকের শেষ দুই দশকে শিশুদের মধ্যে কিছু উদ্বেগজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন সিঙ্গাপুরের মা-বাবারা। তখন ছোট্ট দ্বীপদেশটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির চূড়ার দিকে এগোচ্ছে। সবার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুবিধা নিশ্চিত করায় সেই অগ্রগতির পালে হাওয়া লেগেছিল বেশ জোরেশোরে। কিন্তু একটি নেতিবাচক বিষয়ও তখন স্পষ্ট হয়। শিশুদের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। একপর্যায়ে এটি সিঙ্গাপুরের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়। বিপুলসংখ্যক শিশু কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখলেও দূরে ভালো দেখতে পাচ্ছিল না। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা এ সমস্যা এখন সিঙ্গাপুরের ঘরে ঘরে। সিঙ্গাপুরে যা ঘটছে, মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেটাই ঘটছে। এর জন্য দায়ী মানুষের ভিন্ন ধারার জীবনযাপন। সব দেশেই বাড়ছে ‘মায়োপিয়া’। যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ তরুণের ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা, যা ১৯৭১ সালে ছিল ২৫ শতাংশ। একই হারে এ সমস্যা বেড়েছে যুক্তরাজ্যেও। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে। সেখানে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় ভুগছেন যথাক্রমে ৮৪ ও ৯৭ শতাংশ মানুষ। এ হারে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় পড়বেন। অতীতের যে কোনো সময় থেকে সমস্যাটি দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, জিনগত কারণে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় ভুগছেন অল্পসংখ্যক মানুষ। যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিমা গোরবানি-মোজাররাদ বলেন, পুরোপুরি জিনগত কারণে কেউ ‘মায়োপিয়া’য় আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। তাহলে কেন ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে? মূলত আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতির কারণেই বাড়ছে ‘মায়োপিয়া’। বাইরের পরিবেশে না যাওয়া, ঘরের অভ্যন্তরে অধিকাংশ সময় কাটানো, দীর্ঘ সময় ধরে কাছের বস্তুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাকে দায়ী করছেন গবেষকরা। একটানা দীর্ঘ সময় পুস্তকের দিকে তাকানোও চোখের জন্য ভালো নয় বলে দাবি করেছেন তাঁরা। কারণ হিসেবে গবেষকরা বলছেন, চোখ কাছের বস্তু দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এক সময় দূরের জিনিস দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রভাষক নিমা গোরবানি-মোজাররাদ বলেন, চোখের রেটিনার সীমাবদ্ধতা আছে। তাঁকে অল্প দূরের বস্তু দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে দূরের বস্তু দেখতে সমস্যায় পড়ে। এটা অনেকটা অল্প মাখন বড় রুটির মধ্যে মাখানোর মতো।
বাংলাদেশ ও ভারতের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও এ সমস্যা বাড়ছে। এ দুই দেশে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় ভুগছেন। আফ্রিকা মহাদেশে ‘মায়োপিয়া’ ছিল বিরল। তবে সম্প্রতি সেখানেও এ সমস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে দ্রুতই বাড়ছে।
করোনা মহামারির সময়ে শিশুরা বাইরে বের হতে পারেনি। এ সময় তারা ঘরের ভেতরে ক্লাস করেছে, টেলিভিশন দেখেছে। এটা তাদের চোখের স্বাস্থ্যের জন্য ছিল ক্ষতিকর। এটাকে গবেষকরা নাম দিয়েছেন, ‘কোয়ারেন্টাইন মায়োপিয়া’। সর্বোপরি, বাইরে খেলাধুলা, চলাফেলা থেকে বিরত থেকে ঘরের ভেতরে অভ্যস্ত হওয়াকে ক্ষীণদৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে মানছেন গবেষকরা। তাঁরা শিশুদের প্রকৃতির কাছাকাছি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সূত্র : বিবিসি।