জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক জেলায় যদি পুরো বছর পাঁচজন রোগী পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, আক্রান্তত রোগী অন্য জেলা থেকে এসেছে। তবে এর বেশি হলে ধরে নেওয়া হয় ডেঙ্গু স্থানীয়ভাবে ছড়িয়েছে। সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুর স্থানীয় সংক্রমণ এরই মধ্যে ৪০ জেলায় দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, ডেঙ্গু মোকাবিলা করা কঠিন হবে। জনদুর্ভোগ ও মৃত্যু কোনোটাই সামলানো যাবে না। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনই জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারাবছর অভিযান চালানো এবং কীটতত্ত্ব সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।প্রতিরোধের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ৬৪ জেলার মধ্যে ৫১টিতেই মিলেছে ডেঙ্গু রোগীর অস্তিত্ব। এর মধ্যে ৪০ জেলায় ডেঙ্গুর স্থানীয় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সচেতনতার অভাব ও ডেঙ্গু নিধনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগী। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, ফলে জটিল পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছে রোগীরা। এতে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি।এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২২ ওয়ার্ডে বিভিন্ন মাত্রার ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে অভিযান শুরু করেছে দুই সিটি করপোরেশন, তবু ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন ডেঙ্গু।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গতকাল রোববার পর্যন্ত এ বছর দেশে যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর ২৭ জনই ঢাকার বাইরের। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্তত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সরকারি হিসাবে ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। মাঝে এক বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম থাকলেও ২০২১ সালে ফের ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু ছড়ায়। তাতে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এ রোগ নিয়ে হাসপাতালে যান, মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। চলতি বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩ হাজার ৮৮০ জন। তাদের মধ্যে ১০ হাজার ৭৪৩ জন ঢাকা মহানগরের। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ১৩৭ জন।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত সাতটিতে ১ হাজার ৭৯৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্তত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ জন কক্সবাজারের। চট্টগ্রাম বিভাগে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ২৩ জনের মধ্যে ১৮ জনই ওই জেলার।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সবক’টিতেই এবার ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এ বিভাগে ৩৮০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে যশোর ও নড়াইলে। ঝালকাঠি বাদে বরিশাল বিভাগের সব জেলায় এ বছর ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। যে ৩৩০ জন ডেঙ্গু আক্রান্তত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩১ জন বরিশালের। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে ছয়টিতে এ পর্যন্ত ১৭১ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তত পাবনায়। এ জেলায় ১৪৩ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ময়নসিংহ বিভাগের চার জেলার সবক’টিতেই ডেঙ্গু আক্রান্তত রোগী পাওয়া গেছে। এ বিভাগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২১১ জনের মধ্যে ১৫২ জনই ময়মনসিংহের। রংপুর বিভাগের রংপুর, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরে এ পর্যন্ত ১৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্তত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সিলেট বিভাগের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় এ পর্যন্ত ২৭ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য কিংবা অন্য কোনো বিভাগের নেই। এ নিয়ে অতীতে বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ করেছেন, এর কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। সিটি করপেরেশন বা স্থানীয় মন্ত্রণালয়সহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগী হতে হবে।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, স্থানীয় সংক্রমণ যেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে, এসব এলাকায় দ্রুত শনাক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, জেলা-উপজেলাগুলোতে এখনও এডিস মশা নিধনে কার্যকার ব্যবস্থা নেই। এসব এলাকায় মশা নিধনে জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতি নেই। এ সমস্যা নিরসনে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার নগর কর্তৃপক্ষের অভিজ্ঞতা আছে। তবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পৌরসভাগুলোর দক্ষতা সীমিত। ফলে ডেঙ্গু জেলা থেকে উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ায় সামনে আরও জটিল পরিস্থিতির শঙ্কা রয়েছে। জেলা আক্রান্তত হলে উপজেলাগুলোতেও ডেঙ্গু ছড়াবে। কারণ নগরায়ণের প্রভাব উপজেলা পর্যন্ত চলে গেছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। তবে এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগী। মশা নিয়ন্ত্রণে দেশের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। গঠন করতে হবে জাতীয় মশা নিধন সেল।